মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান (রহ.)
হজ সম্পর্কে কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,
الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَعْلُومَاتٌ فَمَنْ فَرَضَ فِيهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ يَعْلَمْهُ اللَّهُ وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى وَاتَّقُونِ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ
হজ নির্ধারিত কয়েকটি মাসে অনুষ্ঠিত হয়। যে কেউ এই মাসগুলোতে হজের সংকল্প করে, সে যেন হজের সময় স্ত্রী-সহবাস (কোনো প্রকার যৌনাচার) না করে, কোনো পাপাচারে লিপ্ত না হয়, এবং কোনো ঝগড়া-বিবাদ না করে। তোমরা যে সৎকাজ করো, আল্লাহ তা জানেন। আর তোমরা (পরকালের) পাথেয় সংগ্রহ করো। নিশ্চয় সবচেয়ে উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ, তোমরা আমাকেই ভয় কর। (সুরা বাকারা: ১৯৭)
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, হজ কেবল একটি সফর নয়—বরং আত্মশুদ্ধির কর্মশালা।
হজের প্রথা জাহেলি আরবদের মধ্যেও ছিল। কিন্তু ওটা ছিল এক ধরনের উৎসব, বাজার বা মেলা, আল্লাহর ইবাদত নয়। ইসলাম এসে এই উৎসবকে হজরত ইবরাহিমের (আ) নিয়মে ফিরিয়ে দিল, তাকে ইবাদতে পরিণত করল। একটা উৎসবে যেসব বিষয় থাকে, হজের সময়ে তা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এবং এই সময়টায় নিজেকে শুদ্ধ রাখা ফরজ করা হয়।
রাফাস: যৌনাচার ও যৌনতা সংশ্লিষ্ট কথা।
ফুসুক: আল্লাহর অবাধ্যতা ও পাপাচার।
জিদাল: ঝগড়াঝাঁটি ও বাকবিতণ্ডা।
আল্লাহর অবাধ্যতা বা ঝগড়া সাধারণ সময়েও নিষিদ্ধ, কিন্তু হজের সময় এগুলোর ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এই সময়টাতে সফরের কষ্ট ও বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগমের কারণে মানুষের মধ্যে ধৈর্য কমে যায়, ভুল বেশি হয়।
সত্যিকারের মুমিন হচ্ছে সেই, যে জীবনকে ভোগ-বিলাস বা ক্ষণস্থায়ী আনন্দের জন্য নয়, বরং একটি উচ্চতর উদ্দেশ্যের জন্য যাপন করে। যে নিজের প্রতিটি কাজে আল্লাহর বিধান মানার চেষ্টা করে, এবং সামাজিক জীবনে ঝগড়া ও হিংসা থেকে নিজেকে দূরে রাখে। এই গুণগুলো প্রতিটি মুসলমানের সব সময় থাকা উচিত—কিন্তু হজের সময় এগুলোর অনুশীলন জরুরি হয়ে পড়ে। হজে এগুলোর নিষেধাজ্ঞা বেশি জোর দিয়ে আরোপ করা হয়, যেন মানুষ এর গুরুত্ব অনুধাবন করে। যেন সে হজ শেষে নিজ দেশে ফিরে গিয়েও গোনাহ থেকে বিরত থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
প্রকৃতপক্ষে হজ একটি পরীক্ষা। একজন মুমিন কি কেবল শরীর নিয়ে মক্কায় গেছেন, নাকি অন্তরেও হাজি হয়েছেন, তা বোঝা যাবে এসব গুণ অর্জনের মধ্য দিয়ে। যদি হজের সময়ও অশ্লীলতা, ঝগড়াঝাঁটি ও নাফরমানি চলতে থাকে—তাহলে বুঝতে হবে তাকওয়ার আসল শিক্ষা অন্তরে প্রবেশ করেনি।
মানুষ যখন নিজের ঘর-সংসার আর ব্যবসা-বাণিজ্যের ভেতরে ডুবে থাকে, তখন সে নিজের সীমানার বাইরের বাস্তবতা ভুলে যায়। তার চিন্তা আটকে থাকে শুধু নিজের প্রয়োজন, লাভ-লোকসান, খুঁটিনাটি হিসাব-নিকাশে। এই কারণেই তো প্রতিদিন নামাজ পড়ার জন্য তাকে মসজিদে ডাকা হয়। যেন অন্তত কিছু সময়ের জন্য সে নিজেকে দুনিয়ার ব্যস্ততা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে, নিজের মনকে সব দুনিয়াবি চিন্তা থেকে খালি করে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে পারে।
হজের সফরের উদ্দেশ্যও তা-ই, তবে অনেক বড় পরিসরে। হজ হলো একজন মানুষের জন্য তার দুনিয়াবি জগত থেকে পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার নাম, যাতে সে কিছু দিনের জন্য সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।